চিন্তার নেতিবাচক প্রভাব
মুক্তমন বনাম শর্তাধীন মনঃ আমাদের মন একটি বিস্ময়কর যন্ত্র। সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটারের চেয়ে এর বেশি ক্ষমতা রয়েছে। এই শক্তিশালী মন একদিকে যেমন আমাদের পক্ষে কাজ করতে পারে, তেমনি শুনতে কষ্টকর হলেও সত্যি যে এরা অন্যদিকে আমাদের বিপক্ষেও কাজ করতে পারে। আমাদের জীবন, সমাজ, পরিবেশ, আমাদের শত্রু নয়, আমাদের মূল শত্রু আমাদের নিজেদেরই চিন্তা। এই চিন্তা মনকে বিষময় করে তুলতে পারে। আবার সুখ ও আনন্দ দিয়ে ভরে দিতে পারে। কেন আমাদের চিন্তা আমাদের নিজেদের প্রতিপক্ষ হয়? এর কারণ আমাদের শর্তাধীন মন।
চিন্তার ধাঁধা
Image by Author |
অতিরিক্ত চিন্তার কুফল
শর্তাধীন ও মুক্ত মন বোঝাতে হলে কম্পিউটারের উদাহরণ টানা যায়। কম্পিউটারের কোন বিশেষ ধরনের কাজ করতে হলে একটি সফটওয়্যার লাগে। এ সফট্ওয়ারে কিছু প্রোগ্রাম থাকে, যা নির্দেশনা থাকে সেই অনুযায়ী প্রোগ্রাম কাজ করে, এবং এর ব্যতিক্রম কিছু করে না। আমরা যদি ওই নির্দেশনার বাইরে কিছু করতে চায় তাহলে সেই সফটওয়্যার বদলে ফেলতে হবে। ঠিক তেমনি আমাদের মন ও মস্তিষ্কের ছোটকাল থেকে পরিবার, সমাজ থেকে অর্জিত কিছু ধ্যান ধারণা, বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা প্রণালী দিয়ে প্রোগ্রামড হয়ে থাকে। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা, ত্রুটিপূর্ণ চিন্তা প্রণালীর আলোকে আমরা বর্তমানের ঘটনা প্রবাহকে মূল্যায়ন করি ও অর্থ আরোপ করি। যা আমরা বর্তমান বাস্তবতা বলে ভাবছি আসলে তা হচ্ছে ঐ শর্তাধীন তৈরি চিন্তা প্রণালীর নিজস্ব মনগড়া ব্যাখ্যা। আমরা ঘটনাপ্রবাহের সব তথ্য মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে দেই না। একটি ফিল্টার মেকানিজম সেখানে কাজ করে। মনের ফিল্টার শুধুমাত্র সেই ধরনের তথ্য কে গ্রহণ করে, প্রবেশ করতে সুযোগ দেয়, যেগুলো শর্তাধীন মনের সফট্ওয়ারের নির্দেশনার অনুকূলে থাকে। ছোটকাল থেকে বিরূপ অভিজ্ঞতা থেকে, সমাজ ও পরিবার থেকে অর্জিত যে নেতিবাচক শর্তাধীন মন তৈরি হয়েছে; সেই মনের ফিল্টারে কেবলমাত্র নেতিবাচক তথ্য, চিন্তা সহজে ও ঘন ঘন বিনা পাসপোর্টে ও ভিসায় যখন তখন প্রবেশ করতে পারে। এমনকি ভালো ঘটনার মন্দ দিকগুলো মস্তিষ্কে যত দ্রুত ও সহজে প্রবেশ করে তার ইতিবাচক দিকগুলো মনে সেভাবে ঠাঁই পাই না। একে আমরা বলি পক্ষপাত মূলক তথ্য প্রক্রিয়াকরণ। এই শর্তাধীন মন যদি নেতিবাচক সফটওয়্যার দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে সারা জীবন আমরা জীবনকে, জগতকে ঐ নেতিবাচক চিন্তা ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ব্যাখ্যা করে যাব। ঘটনা বা বাস্তবতা যাই হোক না কেন তার ব্যাখ্যা যদি হয় নেতিবাচক, তাহলে তার জীবন প্রণালী ও গড়ে উঠবে নেতিবাচক ভাবে। আমরা এক্ষেত্রে অসহায় হয়ে পড়ি। কেননা মস্তিষ্ক একটি নির্দিষ্ট স্বভাব ধর্ম অনুযায়ী কাজ করে থাকে। সে স্বভাব বা পদ্ধতি যত ত্রুটি যুক্ত হোক না কেন আমরা সে পদ্ধতিতে ভাবতে, অনুভব করতে, ব্যাখ্যা করতে, গ্রহণ বা বর্জন করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, আমরা জীবনকেও বাস্তবতাকে যেভাবে ভাবি দেখি মূল্যায়ন করি বা গ্রহণ করি তা নির্ভর করে আমাদের মন কতটা শর্তাধীন এবং কতটুকু মুক্ত তার উপর। আনন্দের কথা হচ্ছে আমরা এই দাসত্ব মূলক শর্তাধীন মনকে পাল্টে মুক্ত বা স্বাধীন মন তৈরি করতে পারি। তার জন্য বুঝতে হবে নিজের চিন্তার প্রণালী, দৃষ্টিভঙ্গির প্রকৃতি ও স্বরূপ। তেমনি জানতে হবে যে আমাদের চিন্তা ও আমরা এক নই।
চিন্তা ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য করতে না পারলে মানসিকভাবে অসুস্থ রোগী হয়ে পড়বেন।।
Image by Author |
অতিরিক্ত চিন্তা ছেড়ে দেবেন যেভাবে
বড় ধরনের মানসিক রোগ হলে রোগী নিজের চিন্তা ও নিজের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। একে আমরা বলি ইগো বাউন্ডারি ভেঙ্গে যাওয়া। অনেক রোগী মনে করে তাকে নিয়ে রেডিও-টেলিভিশনে বলাবলি হয় বা তার মনের কথা সবাই জেনে ফেলে। কেউ মনে করে পাশের লোকেরা তাকে নিয়ে আলাপ করছে, সমালোচনা করছে। কেউ গায়েবী কথা শুনে, কেউবা ভ্রান্ত বিশ্বাসে ভুগে থাকেন। এই বৈশিষ্ট্যগুলো বড় ধরনের মানসিক রোগের কিছু সংকেত। অর্থাৎ এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তি প্রকৃত বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু আমরা যারা স্বাভাবিক মানুষ তারা বড় ধরনের কোন বিভ্রান্তিতে না ভুগলেও সব সময় যে চিন্তা ও নিজেকে আলাদা রাখতে পারি না। যারা দিবা স্বপ্নের মধ্যে দিন কাটায়, তারা কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে তেমন কোনো ফারাক দেখতে পায় না। অন্যদিকে অনেকেই নেতিবাচক চিন্তার প্রবল স্রোতে এমন ভাবে ভেসে যান যে প্রকৃত বাস্তবতার চেয়ে ঐ চিন্তার নেতিবাচক প্রভাবের মধ্যেই তাদের বসবাস। ছুটন্ত মিসাইলের মতন দ্রুতবেগে নেতিবাচক চিন্তা যেমন তাদেরকে আঘাত করে থাকে তেমনি নিরবিচ্ছিন্ন ছোট খাটো অবাস্তব সব ক্ষতিকর চিন্তা সারাক্ষণ মনের মধ্যে আসা যাওয়া করতে থাকে। এসব ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা ভুলেই থাকি যে, আমি ও আমার চিন্তা কখনো এক নয়। এই পার্থক্যটা ধরতে না পারলে, বুঝতে না পারলে, এবং সে অনুসারে চিন্তা থেকে নিজেকে দূরে না রাখতে পারি তাহলে আমরা বড় ধরনের না হলেও লঘু ধরনের মানসিক রোগে ভুগে থাকব। তাই চিন্তা ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষেত্রে সব সময় সজাগ, স্বদৃষ্টি ও সচেতন থাকা জরুরী। মনে রাখতে হবে আমরা যা কিছুই ভাবি তা সব চিন্তা। কিন্তু সবই বাস্তবতা নয়। বাস্তবতা যাই হোক আমাদের চিন্তা আমাদের মনকে খারাপ বা উৎফুল্ল করে। আমরা দেখলাম চিন্তা ও বাস্তবতার সব সময় এক নয়। কিন্তু বাস্তবতা যাই হোক সে বাস্তবতার ব্যাখ্যা বা তা নিয়ে আমাদের নেতিবাচক ও ইতিবাচক চিন্তার ফলাফল আমাদেরকে ভোগান্তিতে ফেলে দেয়। পরিস্থিতি বা ঘটনা যাই হোক না কেন একে আমরা যেভাবে দেখি, অর্থাৎ যে ধরনের চিন্তা বা মূল্যায়ন করি আমাদের মনের অনুভূতিও হবে সে প্রকারের। রাত দিন জীবন ও পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন জীবিকা পরিচালনা করা, খুবই দুরূহ কাজ। অনেক সময় দেখা যায় ভুল ও কষ্টকর চিন্তা দিয়ে আমরা আমাদের মস্তিষ্ককে ভরে রেখে থাকি। সেসব আমাদের মনের সৃষ্ট ও নিজস্ব ব্যাখ্যা মাত্র। অথচ সে গুলোকে বাস্তবতা মনে করে নিজেরাই কষ্ট পেয়ে থাকি। পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলি। দিনে অন্তত কয়েক শতবার আমরা চিন্তা ও নিজেদের মধ্যে পার্থক্য গুলিয়ে ফেলি। এর একটি প্রধান কারণ চিন্তা আমাদের নিজেদের সৃষ্টি। নিজেদের সৃষ্টির সবকিছুকে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ও বাস্তব বলে মনে করি।
Image by Author |
নেতিবাচক চিন্তা করবেন না
আরেকটি কারণে আমরা চিন্তার ভেতর আটকে পড়ি, কারণ চিন্তাগুলো আমাদের খুবই নিকটে অবস্থান করে। এত কাছে যে এর থেকে দূরে থেকে নিজেদেরকে দেখার অভ্যাস আমাদের অনেকেরই নেই। মনে রাখতে হবে চিন্তা আসলে প্রকৃত বাস্তবতা নয়। এটি বাস্তবতার নিজস্ব ব্যাখ্যা মাত্র। চিন্তাকে বাস্তবতা হিসেবে নয় বরং তথ্য হিসেবে নিন। সব তথ্য সব সময়ই সত্য হয়না, আমাদের জীবনের যা ঘটে তার জন্য যত না আমরা অসুখী; তার চেয়ে বেশি অসুখী থাকি আমাদের মনগড়া নেতিবাচক ব্যাখ্যার জন্য। পূর্বেই বলা হয়েছিল শর্তাধীন মনের নেগেটিভ প্রোগ্রামিং এর জন্য জীবনের সিংহভাগ ঘটনাবলীর ক্ষেত্রেই অনেকের মনে অনবরত, বিষাদ যুক্ত, দুশ্চিন্তা যুক্ত, ও হতাশা যুক্ত চিন্তা আনাগোনা হতে থাকে। যেসব তথ্যের ভিত্তিতে আমরা ঘটনাকে বিশ্লেষণ করছি সেসব তথ্যের সকল কিছু প্রকৃত সত্য নয়। আমাদের ব্যাখ্যার ধরন নেতিবাচক বলে তথ্যগুলো এরকম অর্থে দাঁড়াচ্ছে। মনে যত চিন্তা আসা-যাওয়া করে এসব গুলো হচ্ছেঃ ভিতর বা বাহির থেকে সরবরাহকৃত তথ্য মাত্র। এই সব কানেক্ট করা তথ্য গুলো সব সময় সঠিক হবে তা কিন্তু নয়। এ সব কিছু বাস্তবের প্রতিফলন তা নয়। এক্ষেত্রে আপনাকে নিজের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে ডিসিশন নিতে হবে কোনগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক চিন্তা তা। নেতিবাচক অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকারক চিন্তা গুলোকে বাদ দিয়ে শুভ, ইতিবাচক, ও কল্যাণকর চিন্তা গুলোর দিকে মনোনিবেশ করতে শিখুন। চিন্তাকে এভাবে ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভ, সত্য-মিথ্যা ইত্যাদি ভাগে ভাগ করে কেবলমাত্র ভালো, শুভ ও সত্য চিন্তাকে গ্রহন করুন। মন্দ, অসত্য ও মিথ্যে চিন্তাগুলোকে মনে ঢুকতে দিবেন না। ঢুকে পড়লেও চলে যেতে দিন এর উপর মনোনিবেশ করবেন না।
আরো কিছু জনপ্রিয় টপিকস:
- Different Types of Psychosomatic Disorders.
- জীবনে কার্যকরী ভাবে সুখী হওয়ার উপায়
- অহেতুক চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখবেন যেভাবে।
- What is Dissociative Disorder?
- How to Improve on Self Esteem?
- Symptoms of Obsessive Compulsive Disorder.
- Psychological Factors Responsible for Depression.
- কিভাবে দুশ্চিন্তা দূর করা যায়?
- শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে ভীরুতাকে জয়।
- আত্মমর্যাদাবোধ বাড়ানোর উপায়।
- জীবনে সুখী হওয়ার উপায় ।
0 Comments
Feel free send us your options.